২১ ডিসে, ২০১১

রাজাকার নিধন ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের মৌলিক পার্থক্যঃ রাজনীতি ২০১২

দেশবাসীকে উপদেশ দেয়া আমার উদ্দেশ্য না। কারন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দুই হালি উপদেষ্টা আছে। যদিও সরকারী ওয়েবসাইটে উপদেষ্টা তালিকায় সজীব জয়ের নাম নাই, তথাপি উনি যেহেতু নিজেকে উনার মায়ের উপদেষ্টা হিসাবে পরিচয় দিয়া আনন্দ পান, তাই উনাকে গণনায় ধরতে হচ্ছে। আমার নিজের মাকে উপদেশ দিলে নগদ চটকানা খাওয়ার ভয় আছে। কিন্তু সজীব জয়ের কথা আলাদা। উনি জাতির পিতার আপন নাতি। বাকি ৭ জনের ৪জনের পিএইচডি আছে। ২জন আবার ব্যাপক প্রফেসর। তাই জাতিকে উপদেশ দিয়া ভারাক্রান্ত করতে চাই না। নিজের প্রয়োজনেই লিখা রাখা।

গুপ্ত হত্যা vs. চোরাগোপ্তা খেলা শুরু হৈছে। স্কোর ৪০-২। কোন পক্ষ কোন দিকে গোল দিতেছে বুঝা যাইতেছে না। ব্রুট মেজিরিটির সরকার ৩ বছরের মাথায় আইসা আবর-স্প্রিয়ের ভয়ে প্রি-এম্পটিভ এটাক চালাইতেছে। অজানা হাজার খানেক মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়া রাখছে। যাতে যেখানে যারে সন্দেহ হয়, তারে শ্রী ঘরে ঢোকান যায়। তবে রাজনীতির এই আগুনে কাবাব হৈতেছে পাব্লিক। নিতান্ত আম পাব্লিক।

এদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারে দেশী-বিদেশী মিডিয়াতে বেশ শোড়গোল পড়ছে। এতে বুঝা যাইতেছে বিদেশী মিডীয়াতেও অনেক ইনভেস্টমেন্ট হইতেছে। কোনটা যুদ্ধাপরাধ-কোনটা মানবাধিকার লংঘন এইসবের সংজ্ঞায় যাচ্ছি না। যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে হেন করা হচ্ছে, তেন করা হচ্ছে... এইসব ঢাল সরকার যত্রতত্র ব্যবহার করায় ব্যাপারটা বেশ খেলো হৈয়া গেছে। এমন কি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ঢাকা ভাগের হরতাল সমর্থকদের (এই তালিকায় নব্যপ্রতিষ্ঠিত কিছু সুশীল ব্যানারের অনেক স্বনামধন্য শিক্ষক, কলামনিষ্টও আছেন) সাথে রাজাকার সমর্থকদের  মিল পাইতেছেন। তিনি কচ্ছেন "নিরপেক্ষ বা মধ্যমপন্থী বলে কিছু নেই" ...তাহৈলে উনার সাথে হিটলারের পার্থক্য কোথায় থাক্লো (বিশাল গোঁফটা ছাড়া)?  

তবে হঠাৎ হানাহানির রাজনীতি শুরু হওয়াতে মনে হচ্ছে বিরোধী জোট কোন কারণে আর বসে থাকতে পারতেছে না। কিসে যেন তাদের বেশ তাড়া। ইনফ্লেশন ১০% ক্রস করছে ৩মাসের উপরে। টিপাইমুখ নিয়া সরকারের অবস্থান ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার চেয়েও দূর্বল ও অনুগত। সরকার ৬১ জন জেলা প্রসাশক একরাতে পরিবর্তন করে ভোটের মাঠ সাজাচ্ছে। স্টক মার্কেটে পৌনপুণিক দরপতন ও বিশাল অংকের টাকা গায়েব, তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশে সরকারের নিতান্ত অনিহা। এইসব কোনটাই বিরোধীদলকে তেমন অসুবিধায় ফেলে নাই, যতটা যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্তর্জাতিক(কার্যত দেশীয়) ট্রাইবুনালের মামলার গতি ফেলছে। ঢিমে তালে বছর খানেক চলার পরে হঠাৎ গতি বাড়ার কারন নির্বাচন হতে পারে। আমাদের বিচার বিভাগ মূলত গরুর গাড়ির গতিতে আগায়। সরকারের হাতে হালুয়া পেন্টির বাড়ি না খেলে তার নড়ন-চড়ন তেমন দেখা যায় না। ১৫ আগষ্টের আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার করতে ২বার ক্ষমতায় আসা লাগছে আওয়ামীলীগকে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সরকারের বা দলের থাকতে পারে। উকিলের উদ্দেশ্য প্রফেশনালি অপরাধ প্রমান করা। কিন্তু মনে হইতেছে, তারা তাড়াহুড়া করতে চাইতেছে। এবং বিরোধীদল রাজনৈতিক সহদর বাচাইতে তাড়াহুড়া করে আন্দোলনে যাইতে চাচ্ছে। আবার স্বাধীনতার বিপক্ষ-শক্তির চোরাগোপ্তা হামলা ঠেকাইতে স্বাধীনতার স্বপক্ষ-শক্তির জনবল বৃদ্ধির বিশেষ দরকার পড়ছে তাই সরকার ফাসির আসামী, খুনের আসামী সবাইকে বেকসুর খালাস করে দিচ্ছে।


যুদ্ধাপরাধের বিচারের খবর নিউজ মিডিয়াতে তেমন পরিস্কার করে আশতেছে না। কারন প্রতিটা দৈনিকপত্রিকাই কম বেশি কোন না কোন ব্যবসায়ীক গ্রুপের বেতনভূক, সেই সাথে রাজনীতির ২ মেরুর কোন একদিকে ভরকেন্দ্র সরায়া রাখছে। তারা মাঝে মাঝে সাকা চৌধুরীর যেসব বক্তব্য শুনায়, তাতে মনে হয় ট্রাইবুনাল পল্টনে বসছে, সাকা নিশ্চিন্তে ভাষন দিয়াই যাচ্ছে।


আমি তাই কোট করবো ডেভিড বার্গম্যানের ব্লগ। বার্গম্যান ১৯৯৫ সালে War Crimes File নামের একটি চমৎকার ডকুমেন্ট্রি করেন ও পুরস্কার পান। উনার ব্লগে ভিউজ না দিয়ে তিনি নিউজ দিয়েছেন, ধারাবাহিক জেরার বর্ণনা দিচ্ছেন।
 
সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ প্রমানে প্রথম সাক্ষীঃ ২০০৪ সালে খালেদার আমলে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখাইছেন। তাও আবার সাঈদীর সুপারিশে (সাঈদী আবার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিচ্ছে কবে থেকে? বেহেস্তের টিকিট কি শেষ নাকি?)। পরবর্তীতে আওয়ামী সরকার আমলে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ভূয়া হিসাবে আখ্যা দেন!আশেপাশের গ্রামের পিস কমিটির সদস্যদের নামও বলতে পারতেছেন না। লিঙ্ক 

মুক্তিযুদ্ধের পরে প্রায় ৮২হাজার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও পরে তা বাড়তে বাড়তে ৩ লাখ হৈছে। আবার একি সাথে রাজাকারের সংখ্যাও যুদ্ধের পরে বাড়তেছে। জিয়াউর রহমান, কাদের সিদ্দীকীর মতো অনেকেই নুতুন করে রাজাকারের খাতায় স্থান পাচ্ছেন সরকারী দলের নেক নজরের কারণে।
 
এই বর্ধিত রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ভূয়া। সমস্যা হৈল এইরকম ভূয়া সাক্ষী একটা গেলে সমস্যা নাই। কিন্তু এইরকম অপরিপক্ক সাক্ষী পায়া জেরা করা হৈছে ৩দিন। এইটা স্পষ্টই সময় নষ্ট করার চেষ্টা। আর এই সময়েই রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়তেছে।


আশঙ্কার বিষয়ঃ
রাষ্ট্র বরাবরের মতই প্রসিকিউট করতে ব্যর্থ হৈতেছে। প্রতিটা ব্যর্থতার কন্সিকোয়েন্স আছে। আমরা হাসিনা-খালেদা-এরশাদের দূর্নীতি প্রমান করতে ব্যর্থ হৈছি। তার মাসুল দিচ্ছি। এখন নিজামী-গোলাম আযম-সাঈদীর বিচারেও ব্যর্থ হৈলে- এরা আগামীতে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিবে। গেল কয়েক বছরে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার হইছে, এরপরে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা সাজবে। ৫ বছরের মিউজিকাল চেয়ারের খেলায় বর্তমান বিরোধীদলের ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনাকে প্রকট ধরলে এই বিচার এই সরকারের আমলে শেষ না হলে, আগামীতে আর হবে না।

এরমধ্যে একটা অসহিষ্ণু ক্রাউড তৈরী হৈছে। এরা ৪০ বছর পরে, আর অপেক্ষা করতে পারতেছে না, স্রেফ কয়েকজনকে ঝুলায়া দেয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু ঝুলায়া দেয়াটা বিচারের মূল উদ্দেশ্য না। আজকে ২টা রাজাকারের ফাসি দিলে, মূল অবস্থার তেমন পরিবর্তন হবে কি? আর ৪০ বছর পরে এদের মেমোরিয়াল হবে, সেই খানে সমাজের ১০জন গন্যমান্য লোক স্পিচ দিবে। ১০টা টিভি চ্যানেল, ২ হালি পত্রিকায় নিউজ দিবে। সেই প্রজন্ম হয়তো আমাদেরকেই খুনি, বর্বর বলবে।

কিন্তু যদি ২-৪জনের অপরাধ পর্যাপ্ত আর্গুমেন্ট ও স্ক্রুটীনির মাধ্যমে প্রমাণ করে, ঝুলায়া দেয়া যায়... আর ২০০ রাজাকার তাদের ১৪ গুষ্টি কোন দিন মাথা তুইলা দাড়াইতে পারবে না। 


কিন্তু ট্রাইবুলান যদি পত্রিকার লেখনী দেইখা বিচলিত হয়ে যায়, সম্পাদককে ডাইকা আইনা ঝাড়ি দিতে চায়--তাইলে ফ্রি-ফেয়ার ক্যাম্নে হবে? আসামী পক্ষকে যদি বাই ল(LAW) মাত্র ৩ হপ্তা সময় দেয়া হয়, আর সরকারী উকিল ১ বছর ধরে মামলা গুছায়, তাইলে ফেয়ার হইলো? ডিফেন্সের উকিল, সাক্ষীদের যদি মামলা-মোকদ্দমার ভয় দেখায়, তাইলেতো হবে না।

তার উপরে যদি সরকার প্রথমেই একটা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে শুরু করে, তাইলে বুঝতে হবে, তাদের উদ্দেশ্য তাড়াহুড়া করে দুই-এক্টা রায় দিয়ে বাকিদের ইলেকশন পর্যন্ত ঝুলায়া রাখা। ইলেকশনের আগে চয়েস ফর্ম ফিলাপ করতে হবে "রাজাকারদের কি জেলে দেখতে চান? চাইলে ভোট দেন"। কারন বিএনপি আজ পর্যন্ত রাজাকারের বিচার করবে এমন কোন স্টেটমেন্ট দেয় নাই।



কোয়ালিশন ইলেকশন কমিটমেন্ট
রাজনীতির ঘোলা পানিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের আসল শক্তির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।  সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম আবার সক্রিয় হতে পারে। তারা অরাজনৈতিকভাবে কিছু মৌলিক দাবিতে আওয়ামীলীগ ও বিএনপিকে রাজি করাতে পারে। এটাকে বলা যেতে পারে "কোয়ালিশন ইলেকশন কমিটমেন্ট", নির্বাচনের পরে (নির্বাচন হবে কিনা সেইটা নিয়াও সন্দেহ আছে) যাতে বিচারকাজ আপন গতিতে চলতে পারে সেইজন্য দুইপক্ষে কাছে কিছু স্পষ্ট কমিটমেন্ট আদায় করতে হবে। যেমনঃ 
*ট্রাইবুনাল ভেঙ্গে দেয়া যাবে না
*কোন আইনে বিচার হলে সেটা গ্রহনযোগ্য হয়- সেটা আন্তর্জাতিকমানের হয় সেটার শোনা। শুধু শুধু, ট্রাইবুনালের নিরপেক্ষতা প্রশ্ন করা যাবে না,
*মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের তথ্য-প্রমান দলিল করতে গবেষনায় বরাদ্দ কত হবে ও মূল গবেষক কারা হবেন তার লিখিত তালিকা নেয়া 
* এরকম আরো কিছু পয়েন্টে মতামত আদায় করা যেতে পারে।

তবে এই কাজে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের লে.জেনারেল হারুন-অর-রশিদকে ডেস্টিনি ২০০০লিমিটেডের ডিরেক্টর হিসাবে নয়, হাত বাড়াতে হবে চেয়ে প্রবল জনসমর্থন আদায়ে। স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির এইটাই শেষ সুযোগ। আমাদের এক্ষনী আরেকজন জাহানারা ইমাম প্রয়োজন।
ছবিঃ মেঘ রোদ্দুর

কোন মন্তব্য নেই: