২৫ মার্চ, ২০১২

রায় না বুঝেই সমুদ্রজয়ের হল্লা: দিপুমনির অজ্ঞতা, নাকি জনগনকে আরেকটি বাজিঙ্গা?


হঠাৎ সমুদ্র জয়ের যে হল্লা শোনা গেল, তার কয়েক ঘন্টা আগে থেকেই সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের (ITLOS) ওয়েবসাইটে ওয়েবসাইটেনজর রাখছিলাম। জার্মানির সেই ট্রাইবুনালের সাইটে প্রথমেই সেই রায়ের কপি দেয়া হলো...ডাউনলোড করে সেটা পড়তে শুরু করলে বাংলাদেশের কুটনৈতিক ব্যার্থতার এক কালপঞ্জি দেখতে পেলাম ...সে কথায় পরে আসছি।

কিন্তু রায় দিতে না দিতেই
রয়টার্সে , বিডিনিউজ২৪ ও প্রথম আলোতে রায়ের ফলে বিশাল বিজয় অর্জিত হয়েছে---পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য পেলাম। নিঃসন্দেহে এই বিষয়ে মীমাংসা একটি বিশাল খবর। কিন্তু পূর্ণ রায় পড়লে বোঝা যায় আমাদের কিছু অংশে জয় হলেও, গভীর সমুদ্রের কয়েকটি পূর্বঘোষিত ব্লক (কমপক্ষে ৬ টি) হাতছাড়া হয়ে গেছে।

গতকাল প্রথম আলোর একটি সংবাদে হালকা করে বলা হয়: "হিসাব মেলাতে দরকার চুলচেরা বিশ্লেষণ"
আজকের সংবাদে একদম পরিস্কার ভাবে এই কথাটাই এসেছে ---

ইটলসের রায় ঘোষণার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, বাংলাদেশ যা চেয়েছিল, তার চেয়েও বেশি পেয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রায়টি বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে ঠিকই, কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন, সেটা বাস্তবের তুলনায় অনেকটা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলার মতো হচ্ছে।


রায়ের পূর্ণ কপি ও বাংলাদেশের সমুদ্র ব্লক্গলোর ছবি দেখলে ব্যাপারটা পরিস্কার বোঝা যাবে।


আমার মতামত হলো :
আর্ন্তজাতিক এই বিরোধের মিমাংসা একটা বড় অর্জন, যার মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে আমাদের আর বাধা থাকলো না মায়ানমারের সাথে। একই রকমভাবে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার বিরোধ মেটাতে গেলে এই রায়ের ফল আমাদের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনার টেবিলে অনেক সুবিধা করে দিবে। তবে আসছে এপ্রিলে পেট্রোবাংলার বিডিং শুরুর আগে পিএসসি ২০০৮ এর সংশোধন না হলে এই বিজয়ের ফসল ঘরে আসবে না।

নুতুন মিমাংসিত সমুদ্রসীমানার সাথে পেট্রোবাংলার অফশোর বিডিং এর ম্যাপ মেলালে দেখা যায় আমাদের কয়েকটি গভীর সমুদ্রব্লক মায়ানমারের দখলে গেছে। তবে বিরোধের নিষ্পত্তি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কিছু পুরনো ভুলকে সামনে এনেছে।


১. ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ৮ বার মায়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরেও কোন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় নাই, সেই সাথে মিটিং মিনিটসে দুই পক্ষের সম্মতির স্বারক স্বাক্ষর থাকলেও, মায়ানমার ট্রাইবুনালকে জানায়, তারা "তথাকথিত" ১৯৭৪ এর সমঝোতাকে চুক্তি হিসাবে মানে না। জবাবে ট্রাইবুনাল জানায় মিটিং মিনিটসে মায়ানমারের পক্ষে স্বাক্ষরকারী কর্তা ব্যক্তির তার দেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কোনো এখতিয়ার ছিল না। একারণে বাংলাদেশের আবেদন নাকচ হয়ে যায়। এখানে মায়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোকনার সম্মতিকে আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে পরিনত করার ব্যর্থতার ফলেই আলোচ্য বিরোধের সূত্রপাত ঘটে।

২. মায়ানমার গভীর সমুদ্রে তেলগ্যাস অনুসন্ধান করতে কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানিকে কাজ দেয় এবং ২০০৮ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি জাহাজ প্রথম বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় মায়ানমার নেভির জাহাজ ও ৪টি ড্রিলিং শিপসহ দেখতে পায়। এর প্রায় ১ বছর আগে মায়ানমারের গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান অভিযানের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডারের খবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় জানতে পারে নাই বা জানলেও দ্রুত দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে সমাধান করতে যায় নাই। সেটা করা গেলে মায়ানমারের সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক রেখেই সমস্যার সমাধান করা যেত। কারণ মায়ানমার দায়্যুকে বিবাদমান AD-৭ গ্যাস ব্লকটি অনুসন্ধানের জন্য বরাদ্দ দেয়ায় দেশটির বা দায়য়ুর বেশ ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।

পত্রিকার প্রকাশিত খবরে বলা হয়ঃ

"সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম তামিম বলেন, নতুন ব্লক করার জায়গা খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না, বরং বিদ্যমান ব্লকগুলোর পূর্ব প্রান্তের কয়েকটি ব্লক সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মিয়ানমানের সীমানাভুক্ত হবে। এমনকি, গভীর সমুদ্রের ১১ নম্বর ব্লকের যে অংশের মালিকানা দাবি করেছিল মিয়ানমার, ইটলসের রায়ে তারও সবটা বাংলাদেশ পায়নি। ওই ব্লকের কিছু অংশ মিয়ানমানের অধিকারভুক্তই রয়ে যাচ্ছে। তবে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধিকার পাওয়ায় দু-একটি নতুন ব্লক সৃষ্টি ও বাংলাদেশের মাছ ধরার সুযোগ বাড়বে।"


 ছবিটি রায়ের আংশিক অংশের---যেখানে বাংলাদেশে সত্যিকারের বিজয় হয়েছে, যা অনেক দৈনিকে গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এটি পয়েন্ট ৮ পর্যন্ত জ্যুম করা ছবি।
কিন্তু পয়েন্ট ৮ এর পরে একটা লম্বা লাইন টানা হয়েছে পয়েন্ট ৯,১০,১১ নিয়ে ....সেই ছবিটি রায়ের শেষের দিকে ১৪৬ পাতায় পাবেন। 





ছবি দুটো খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে, আমাদের গভীর সমুদ্র ব্লক ১৮, ২২, ২৩, ২৬, ২৭, ২৮ নিশ্চিত ভাবেই মায়ানমারের দখলে পড়েছে

মোট হিসাবে আমাদের ২৮ টা ব্লকের মধ্যে ....৬টি পূর্ণ ব্লক আর ৪টি ব্লকের অর্র্ধেক গেছে আর আয়তনের হিসাব রায়ের ১৪২ পাতায় ৪৯৯ প্যারায় বলা আছে,----------- বাংলাদেশ ও মায়ানমারের রেশিও ওফ এলোকেটেড এরিয়া ১: ১.৫৪ ইন ফেবার অফ মায়ানমার 

--এখানে সমুদ্রজয় কে করলো তাহলে ?

সিঙ্গাপুরের ন্যানইয়াং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (NTU) সমুদ্র নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও অস্ত্রালিয়ার সাবেক নৌ-কমডোর স্যাম বেটম্যান বলেন " বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দিম্পু মনি এই রায়কে তার দেশের বিজয় হিসেবে দাবি করলেও, আসলে মায়ানমার এটিকে তাদের বিজয় হিসেবে দেখতে পারে। কারণ তারা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি সীমানা পেয়েছে আর বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সীমানা নির্ধারণের দাবিতে পূর্ণ স্বদব্যবহার করতে, যে কারণে বাংলাদেশের দাবি বাতিল হয়ে যায়"। 


তাতে কি হয়েছে? সরকারের বিশাল রাজনৈতিক জয় হয়েছে!
চিয়ার্স 



-------------------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যে: বাপেক্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্র্ম্চারী এবং ব্লগার দিনমজুর

কোন মন্তব্য নেই: